মুক্তির পথ বা ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়ার পথ সর্বদা স্ত্রীসঙ্গ করতে নিষেধ করে , এবং পূর্ণ সনাতন ধর্ম বা বর্ণাশ্রম ধর্ম স্ত্রীলােকদের সঙ্গ করতে নিষেধ করে বা তা নিয়ন্ত্রণ করে । কামদেবের কাজ হচ্ছে জড় কাম । উদ্দীপ্ত করা । কামদেবের বাণের আঘাতে জর্জরিত হয়ে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড চালিত হচ্ছে । স্ত্রী এবং পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণই হচ্ছে জগতের সমস্ত কার্যকলাপের প্রকৃত প্রেরণা । পুরুষ তার মনােমতাে সঙ্গিনীর অন্বেষণ করছে , এবং স্ত্রী তার যােগ্য পুরুষের অন্বেষণ করছে । সেটি হচ্ছে জড় জগতের উদ্দীপনা , এবং যখনই একজন পুরুষ একজন স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় , তখনই যৌন সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে । তার ফলে গৃহ , মাতৃভূমি , সন্তান , সমাজ , মৈত্রী এবং সম্পত্তি সংগ্রহের প্রতি স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই আকৃষ্ট হয় । সেটি তখন তাদের মায়িক কার্যক্ষেত্রে পরিণত হয় । এইভাবে দুঃখ - দুর্দশাপূর্ণ অনিত্য । জড় অস্তিত্বের প্রতি মিথ্যা অথচ অপরিহার্য আকর্ষণ প্রকট হয় । তাই যারা ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়ার জন্য মুক্তির পথে বিচরণ করছে , সমস্ত শাস্ত্রে তাদের জড় জগতের এই সমস্ত আকর্ষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে । মহাত্মা বা ভগবদ্ভুক্তের সঙ্গ প্রভাবেই কেবল তা সম্ভব । কামদেব জীবদের উপর তার শর নিক্ষেপ করে তাদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি উন্মাদ করে তুলছে , তা সে । সুন্দর হােক বা অসুন্দর হােক । কামদেব এইভাবে সকলকে প্ররােচিত করছে , এমন কি সভ্য মানুষদের বিচারে অত্যন্ত কুৎসিত পশুদেরও । এইভাবে কামদেব সব চাইতে কুৎসিতদের উপরেও তার প্রভাব বিস্তার করছে ; অতএব যারা সর্বতােভাবে সুন্দর , তাদের আর কী কথা । ভগবান শিব , যাকে পরম সহিষ্ণু বলে মনে করা হয় , তিনিও কামদেবের বাণের আঘাতে মােহিনীরূপী ভগবানের অবতারের প্রতি উন্মত্ত হয়েছিলেন । এইভাবে শিবও কন্দপের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন । কিন্তু কামদেব স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর গম্ভীর ও উত্তেজনাপ্রদ আচরণে বিমােহিত হয়েছিলেন এবং নিরাশ হয়ে স্বেচ্ছায় তাঁর ধনুর্বাণ পরিত্যাগ করেছিলেন । শ্রীকৃষ্ণের মহিষীরা ছিলেন এমনই সুন্দরী তথাপি তারা ভগবানের দিব্য ইন্দ্রিয়সমূহকে বিচলিত করতে পারেননি । তার কারণ হচ্ছে যে তিনি পূর্ণ আত্মারাম । তার আনন্দের জন্য কোন বাহ্যিক সাহায্যের আবশ্যকতা হয় না । তাই তাদের রমণীসুলভ আকর্ষণের দ্বারা ভগবানকে সন্তুষ্ট করতে না পেরে মহিষীরা তাদের ঐকান্তিক প্রেম ও সেবার দ্বারা তাকে সন্তুষ্ট করেছিলেন । অনন্য দিব্য প্রেমের দ্বারাই তারা ভগবানকে প্রসন্ন করতে পেরেছিলেন , এবং ভগবানও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে পতিরূপে তাদের সঙ্গে ভাবের আদান - প্রদান করেছিলেন । এইভাবে তাদের ঐকান্তিক সেবায় তুষ্ট হয়েই কেবল তিনি তাঁদের অনুরক্ত পতির মতাে তাদের সেবার প্রতিদান দিয়েছিলেন । তা না হলে তাঁর এতজন পত্নীর পতি হওয়ার কোন প্রয়ােজন ছিল না । তিনি সকলেরই পতি , কিন্তু যিনি তাঁকে এইভাবে গ্রহণ করেন , তিনি সেইভাবেই তাদের প্রতিদান দেন । ভগবানের প্রতি অনন্য প্রেমকে কখনও জড় কামের সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয় । তা সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ চিন্ময় । মহিষীরা যে স্বাভাবিক রমণীসুলভ ভাব নিয়ে ভগবানের সঙ্গে আচরণ করেছিলেন তাও ছিল দিব্য , কেননা চিন্ময় আনন্দের অনুভূতিতে তা ব্যক্ত হয়েছিল । ভগবানকে একজন সাধারণ পতির মতাে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তার পত্নীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল চিন্ময় , বিশুদ্ধ , এবং জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ।
কারা দেব-দেবীর উপাসনা করেন এবং কেন?
সপ্তম অধ্যায় বিজ্ঞান-যোগ কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ। তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।। [ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, অধ্যায় - ৭, শ্লোক - ২০ ] অনুবাদঃ জড় কামনা-বাসনার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারা অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে। তাৎপর্যঃ যারা সর্বতোভাবে জড় কলুষ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে, তারাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করে তাঁর প্রতি ভক্তিযুক্ত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত জীব জড় জগতের কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে না পারছে, ততক্ষণ সে স্বভাবতই অভক্ত থাকে। কিন্তু এমন কি বিষয়-বাসনার দ্বারা কলুষিত থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ ভগবানের আশ্রয় অবলম্বন করে, তখন সে আর ততটা বহিরঙ্গা প্রকৃতির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না; যথার্থ লক্ষ্যের প্রতি উত্তরোত্তর অগ্রসর হতে হতে সে শীঘ্রই সমস্ত প্রাকৃত কাম-বিকার থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত শুদ্ধ ভক্তই হোক, অথবা প্রাকৃত অভিলাষযুক্ত হোক, অথবা জড় কলুষ থেকে মুক্তিকামীই হোক না কেন, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে ...

0 Comments